ঢাকা , শনিবার, ১০ মে ২০২৫ , ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কৃষিকাজে বিপর্যয়ের শঙ্কা

কলাপাড়ায় অর্ধশত স্লুইসগেট অকেজো

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ০৯-০৫-২০২৫ ০৩:৪৮:৩৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৯-০৫-২০২৫ ০৭:৫২:৫১ অপরাহ্ন
কলাপাড়ায় অর্ধশত স্লুইসগেট অকেজো ফোকাস বাংলা নিউজ
উপজেলার কাঠালপাড়ার ছয় ভেন্টের স্লুইসটির দুই দিকের মূল পিলারের পলেস্তরা খসে খসে পড়ছে। রডগুলো জং ধরে বেরিয়ে গেছে। গেটগুলো লোনা পানিতে নষ্ট হয়ে আছে। অনবরত লোনা পানি ওঠানামা করছে। সামনের দুই দিকের গাইড ওয়াল অনেক আগেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। দুই দিকের নিরাপত্তা রেলিং ভেঙ্গে উধাও হয়ে গেছে। পানি ওঠানামার সময় ঝাকুনি অনুভূত হয়। মনে হয় এই বুঝি ধসে পড়বে। প্রত্যেকটি গেটের উপরে ঝোলানো রয়েছে বেহুন্দী জাল। যা পেতে মাছ ধরা হয়। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চাকামইয়া ইউনিয়ন ছাড়াও বরগুনার তালতলী উপজেলার কড়ই বাড়িয়া, পঁচা কোরালিয়া ও বগী ইউনিয়নের অন্তত ৩০ গ্রামের মানুষ কৃষিকাজে এই স্লুইসটি ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু ৬৫ সালের দিকে নির্মিত এ স্লুইসটির বর্তমানে জীর্ণদশার যেন শেষ নেই।

স্লুইসসহ চলাচলের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কলাপাড়ার সঙ্গে তালতলীর তিনটি ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিচ্ছিন্নের শঙ্কা রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। অবস্থা এমন হয়েছে যে, স্লুইস সংলগ্ন কচুপাত্রা নদীর দুই পাড়ের অন্তত ৩০ হাজার কৃষক কৃষিকাজ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। তারপরও এ স্লুইসটির কপাটগুলোর সামনে জাল পেতে মাছ ধরে একটি মহলের দৈনিক আয় পাঁচ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত ২৫ বছরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে অন্তত ৩০টি। মামলা হয়েছে অসংখ্য। যখন যারা ক্ষমতাসীন থাকেন তাদের দখলে থাকে স্লুইসটির নিয়ন্ত্রণ। স্লুইসটি নিয়ন্ত্রণ করে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে অনেকের। কিন্তু স্লুইসটির জীর্ণদশার পরিবর্তন ঘটেনি। এলাকাবাসীর দাবি এই স্লুইসটি ফের জরুরিভাবে নতুনভাবে নির্মাণ করা হোক। নইলে বিধ্বস্ত হয়ে এলাকার ব্যাপক সর্বনাশ হবে। 

এভাবে পক্ষিয়াপাড়া, মেলাপাড়া, পূর্ব-মধুখালী, চরপাড়া, সাফাখালী, নাচনাপাড়া, সুলতানপুর, লোন্দা, হাফেজ প্যাদা, পাটুয়া, দেবপুর, দশকানি, আনিপাড়া, গাজীর খাল, টিয়াখালী, ইটবাড়িয়া, সদরপুর, পূর্ব গৈয়াতলা, ডালবুগঞ্জ, সুলতানপুর, নজিবপুর, দরজার খাল, নিজামপুর শতকরা ৫০ ভাগ স্লুইস কৃষকের কোন কাজে আসে না। বর্তমানে বহু স্লুইসগেট অকেজো থাকায় খালবিলে লোনা পানির প্রবেশ ঘটেছে। বহু কৃষকওে রবিশস্য পর্যন্ত লোনা পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। নীলগঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুগীর স্লুইস। ফি বছর স্থানীয় কৃষকরা নিজেদের অর্থায়নে লোনা পানির প্রবেশ ঠেকাতে স্লুইসটির রিভার সাইটের সংযোগ খালে বাঁধ দেয়। এরপরে ভিতরে খালের মিঠা পানি ব্যবহার করে ১২ মাস সবজির আবাদ করেন। কুমিরমারা, মজিদপুর, এলেমপুর গ্রামে শতকরা আশি ভাগ কৃষক সবজির আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। কৃষক সুলতান গাজী জানান, তাদের গ্রামের উৎপাদিত সবজি কলাপাড়ার গোটা উপজেলার চাহিদার অর্ধেক যোগান দেয়। অথচ এই স্লুইসটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ মেরামত করা হয় না।

খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, প্রকৃত কৃষকের নিয়ন্ত্রণে নেই শতকরা ৯০ ভাগ স্লুইস। প্রভাবশালীরা অলিখিতভাবে আবার মাছ ধরার জন্য লিজ দেয়। নিয়ম রয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পানিউন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে স্লুইসগেট নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে। যেখানে ইউপি চেয়ারম্যান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন কর্মকর্তা ও গ্রামের বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রকৃত কৃষকদের অংশ গ্রহণে এই কমিটি গঠণ করার কথা। কিন্তু এসব প্রকৃত অর্থে করা হচ্ছে না। ফলে প্রকৃত কৃষকের ভোগান্তির যেন শেষ নেই।

গ্রামের সাধারণ কৃষকরা জানান, এই স্লুইসের নিয়ন্ত্রণ করে রাজচনৈতিক দলের লোকজন। বিগত আওয়ামী লীগের সময় তাদেও লোকজন জাল পাতা নিয়া রক্তাক্ত সংঘর্ষে জড়িয়েছে। আবার ওইদল যাওয়ার পরে বিএনপির লোকজনে এখন এসব স্লুইসগেট নিয়ন্ত্রণ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ইউএনও অফিস তাদের কারো এ নিয়ে তেম কোন চিন্তা নাই। আর জনপ্রতিনিধিরা প্রভাবশালীদের সঙ্গেই থাকে। স্লূইসগুলো মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে কৃষকের সর্বনাশ করে আসছে। এভাবে অন্তত অর্ধশত স্লুইস এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। রয়েছে বিধ্বস্ত দশায়।স্থানীয় বাসীন্দা রুহুল আমিন রুহুল আমিন সিকদার জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে চম্পাপুর ও ধানখালী ইউনিয়নের অন্তত ১৩টি খাল ভরাট করে বিলীন করা হয়েছে। আবার পায়রা বন্দরের উন্নয়নে খালবিল ভরাটের পাশাপাশি লালুয়ার মানুষের সর্বনাশ করা হয়েছে।  তিনটি ইউনিয়নের নয় টি স্লুইসগেট অচল হয়ে গেছে। মানুষ এখন জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। বসবাস করার পরিবেশ পর্যন্ত নেই। নতুন স্লুইস গেট নির্মাণ ও পুরনো স্লুইসগেট রক্ষণাবেক্ষনের দাবিতে কলাপাড়ায় কৃষক সমিতির উদ্যোগে সর্বশেষ গত ১৭ এপ্রিল পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যলয়ের সামনে কৃষকরা অবস্থান ধর্মঘট করেন। তারা ওই দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার তথ্যানুসারে কলাপাড়ায় ৪৭ টি ফ্লাসিং (এফএস), ৫৮টি ড্রেনেজ (ডিএস) এবং ২২ টি পাইপ-ইনলেটসহ ১২৭টি স্লুইসগেট রয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহআলম জানান, এর মধ্যে ১২ টি সম্পূর্ণ অকেজো রয়েছে। এছাড়া অন্তত ৩০টি আংশিক খারাপ রয়েছে। ইতিপূর্বে বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে লতাচাপলী ইউনিয়নে ৪৮ নম্বর পোল্ডারের আটটি স্লুইস নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। নীলগঞ্জের নিচকাটা আট ভেন্টের স্লুইসটি অপসারণ করে নতুনভাবে করা হচ্ছে। এ ছাড়া ৪৫ টি স্লুইসের উভয় দিকে গেট সংষ্কার করা প্রয়োজন। এছাড়া কাঠালপাড়ার স্লুইসটিও নতুনভাবে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কুমিরমারা গ্রামের কৃষকের জন্য যুগীর স্লুইসটির সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এসব স্লুইস মেরামত করার কথা জানালেন এ প্রকৌশলী।

বাংলাস্কুপ/ প্রতিনিধি/এনআইএন


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ